যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য টেলিভিশন ও রেডিও ব্যক্তিত্ব ল্যারি কিং। ১৯৩৩ সালের ১৯ নভেম্বর নিউইয়র্কে তাঁর জন্ম। অসাধারণ বিচক্ষণ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য পেয়েছেন অ্যামি অ্যাওয়ার্ড, দুবার পিবডি অ্যাওয়ার্ড এবং ১০ বার কেব্ল এসিই অ্যাওয়ার্ড। ১৯৫০-১৯৬০ সালে ফ্লোরিডার স্থানীয় সাংবাদিক ও রেডিও উপস্থাপক হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত একটি জাতীয় রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে আলোচিত হন। ১৯৮৫ সালে তাঁর বিখ্যাত ল্যারি কিং লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় সিএনএন চ্যানেলে, যা আজ অবধি জনপ্রিয়ভাবে চলছে। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর সিএনএন-এ ল্যারির শেষ শো হওয়ার কথা রয়েছে।
তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অপলক তাকিয়ে থাকতাম রেডিওটার দিকে। আমি জানি না, কেন; কিন্তু আমি রেডিওতে থাকতে চাইতাম। মোহাচ্ছন্ন হয়ে যেতাম রেডিওর শব্দতরঙ্গের মধ্যে। আরেকটু বড় হলে, যখন আমার বয়স সাত-আট বছর, আমি মনোযোগ দিয়ে রেডিওর কথা শুনতাম এবং নিজেকে রেডিওর মানুষগুলোর মতোই অনুকরণ করতাম। তাদের নকল করে কথা বলতাম, দাঁড়াতাম, বসতাম, আয়নায় দাঁড়িয়ে এমনভাবে বলতাম, ‘দ্য রোমান্স অব হেলেন ট্রেন্ট’-এর ঘোষক যেন আমিই। বড় হয়ে বেসবল খেলতে খেলতে কখনো কখনো নিজেই খেলা থেকে সরে খেলার ধারাবর্ণনা শুরু করে দিতাম। আমাকে ধারাভাষ্যকার দেখে বন্ধুরা অবাক হয়ে যেত। আসলে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই একজন ধারাভাষ্যকার। ঘোষক কিংবা উপস্থাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, যখন ওভাবে কোনো গণমাধ্যমই গড়ে ওঠেনি। তেমনটি ভাবনা, তখন কল্পনা ছাড়া কিছুই ছিল না।
হাইস্কুল শেষে তেমন ভালো কোনো গ্রেড এল না যা নিয়ে কলেজে পড়ব। বাবা মারা গেলেন এবং তখন মাকে সাহায্য করা জরুরি ছিল। তাই অনেক ছোটখাটো ‘অড জব’ করতাম—পার্সেল সার্ভিসের ট্রাকেও কাজ করেছি। বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করেছি আর স্বপ্ন দেখেছি রেডিওতে কাজ করার।
বয়স যখন ১৮, তখন স্বপ্নগুলো বাস্তবতার রূপ পেতে শুরু করল।
আমি জানতাম, আমি ধারাভাষ্যকার হতে চাই। কিন্তু কখনোই ভাবিনি যে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কিংবা উপস্থাপক হয়ে বসব। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল হার্ভি। হার্ভির বাবার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তিনি যখন জানলেন আমি ধারাভাষ্যকার হতে চাই, তখন তিনি তো রীতিমতো চড়াই হয়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি কি পাগল হয়েছ? তুমি আর্থার গডফ্রে হতে চাও? একটা ভালো চাকরি নাও, যার ভবিষ্যৎ আছে।’ ওই বয়সে কি এতটাই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল? স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতেই তো দিন কেটে যেত। ২২ পেরোলে আমি মায়ামি চলে যাই এবং দ্বারে দ্বারে ঘোরা শুরু করে দিই। থাকতাম খালার বাসায় একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে। ঘুমাতাম সোফায়। মায়ামিতে সামান্য একটা রেডিও স্টেশনে প্রথম ‘মাইক-টেস্ট’ হলো। মার্শাল সিমন্ডস বলল, গলা ভালো, কিন্তু জায়গা নেই কাজ দেওয়ার। বরং এই জায়গাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নাও। সপ্তাহে সামান্য এই কটা ডলার পাবে। কোনো লোক কাজ ছেড়ে চলে গেলে তোমায় নিয়ে নেব। কী পরিহাস! একদিন টম বয়ার নামের একজন চলে গেল। কারণ তাকে এখানে ঠিক পারিশ্রমিক দিয়ে রাখা হয়নি। টম বয়ারের জায়গায় আমাকে চাকরি দেওয়া হলো। প্রতিদিন নয়টা থেকে পাঁচটা, মাইনে পাব টম বয়ারের চেয়ে ১০ ডলার কম।
রেডিওতে কখনো ঘাবড়ে যাইনি। অবশ্য প্রথম টেলিভিশনে শো করতে গিয়ে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, কারণ ওই দিন আমি বিশেষ কিছু শিখেছিলাম। শেখা বিশেষ এই বাক্যটি আর্থার গডফ্রের কথা। এই ক্ষেত্রটির একটি গোপন কথা হলো, এখানে কোনো গোপন কিছু নেই। এখানে শুধু নিজেরই হওয়া চাই। যদি তুমি নিজে ভিন্ন কিছু হও, তবে তুমি এই ভিন্ন হওয়ার পথেই এগিয়ে যাবে। সেটা যদি তুমি না হও, তবে তুমি অন্য কারও মতো হতেও পারবে না। অন্য কাউকে অনুকরণও করতে পারবে না ঠিকঠাক।
রেডিওতে কাজ করতে করতে ১৯৬০ সালের মে মাসের একটি রাত্রিকালীন শো’র মধ্য দিয়ে আমার সুযোগ এসে যায়। তখন অবশ্য একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পারছি, আমাকে ‘শুভ অপরাহ্ন’ বলে শুরু করতে হবে, কিন্তু আমি বলতে পারছিলাম না। ক্যামেরা চালু হতেই শূন্যতা বোধ হচ্ছিল। শেষমেশ সম্ভাষণ না জানিয়েই পরের বাক্যগুলো দিয়েই অনুষ্ঠানটি শুরু করতে হয়েছিল। প্রযোজক উপস্থিত দুজন উকিলের মধ্যে আমাকে এমন একটি চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে পেছনে কোনো হেলান দেওয়ার জায়গা নেই। চেয়ারটি কাঁপছিল, নড়ছিল বেশ। সঙ্গে আমিও। থামাতেই পারছিলাম না। কিন্তু এভাবেই সবকিছুর শুরু, আর যেখান থেকে কোনো কিছু থেমে যায়নি।
সারা জীবন আমার কাছের বন্ধুদের অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমার সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু হার্ভি, এর্নি কোভাকস, ফ্রেড ইউলপন—সবাই প্রভাবিত করেছে আমাকে। আমি দেখেছি, যদি আমি বন্ধুর জন্য কিছু করি, তবে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে তারাও আমার জন্য সেটাই করবে। আমি সেটা মনেও করি না যে তা ফেরত পাব। আমি সারা জীবন যাদের সম্পর্কে বেঁধে রাখতে চেয়েছি, তাদের অনেকে আমাকে ব্যবহার করেছে, আমার থেকে সুযোগ নিয়েছে। আমার অনেক ভুল ছিল। কিন্তু, কিছু পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার আনন্দটা অনেক বেশি। ব্রুকলিনের সংস্কৃতিতে বড় হতে হতে আমি কোনো কিছু দেওয়ার শিক্ষাটা পেয়েছি। শিখেছি, আমি হার্ভির প্রয়োজনে কিছু করলে, হার্ভি আমার প্রয়োজনে এসে পাশে দাঁড়াবেই। বন্ধুত্বের এই আস্থার ক্ষেত্রটাই আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
হতাশা সহজে মানুষকে পরাভূত করে ফেলে। এর গতিটা অনেক দ্রুত, কিন্তু একে তুমিই থামাতে পারো। হতাশা ও বিষণ্নতা বধ করার শক্তি তোমার মধ্যেই আছে। আর বিপদ আসবেই। একে নিয়ে কাজ করতে হবে। সত্তরের দশকের দিকে আমি আমার প্রায় সব কাজ হারিয়ে ফেলি নিক্সন-জটিলতার কারণে। দেনা হয়ে যায় অনেক। কারণ, টাকা-পয়সা গুছিয়ে খরচ করার ধাত ছিল না। কিন্তু এই বিপদটাই আমাকে সামলে নেওয়ার শিক্ষাগুলো দিয়েছিল, যা জীবনের বড় সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে সামর্থ্য জুগিয়েছে।
আমি জীবনকে অনেক দেখেছি। জীবনও আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে নিয়েছে। আমি দেখেছি, অনেক চিকিৎসককে, যাঁরা এ ক্ষেত্রে বিষণ্ন হয়ে পড়েছেন। আইন পড়তে পড়তে উকিলরা সব ছেড়েছুড়েও অন্য পথে হেঁটে গেছেন। ব্যবসায়ীদের বলতে দেখেছি, যদি তেমন কিছু হতে পারতাম! কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই একটা শিল্প আছে, যা আনন্দ জোগায়, যাকে আপন করে নিতে হবে। ধারাভাষ্যকার হওয়ার সেই স্বপ্ন। ৫৫ ডলারের সেই চাকরি আর আজকের জগৎখ্যাত মিডিয়ার একজন হওয়ার প্রতিটি ক্ষেত্র আমাকে প্রবল উৎসাহ এনে দিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে। তোমাকে বুঝতে হবে, তুমি কী চাও। সেটাই তোমার জন্য ঠিক, আর সেটা যে মাধ্যমেই হোক না কেন। খুঁজে দেখো তোমার মনের সেই ইচ্ছাকে। জীবনে এখনো তেমন দেরি হয়নি।
Sent via Micromax
No comments:
Post a Comment